রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৩ অপরাহ্ন

পরিস্থিতি বুঝে আন্দোলনের ডাক দেবে বিএনপি

পরিস্থিতি বুঝে আন্দোলনের ডাক দেবে বিএনপি

স্বদেশ ডেস্ক:

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে পরিস্থিতি বুঝে আন্দোলনের ডাক দেবে বিএনপি। এ নিয়ে দলটির নেতারা খুব তাড়াহুড়া করতে চান না। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে কীভাবে আদায় করা যায়, এটাই একমাত্র ভাবনা দলটির। এই ভাবনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, দুই জোট ও পেশাজীবীদের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে চান দলটির নীতিনির্ধারকরা। এই ইস্যুতে আন্দোলনে যাওয়ার বার্তা দিয়ে এরই মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির দুই দফায় ছয়দিন রুদ্ধদ্বার সিরিজ বৈঠক শেষ করেছে দলটি। আজ দলের স্থায়ী কমিটির সভায় দুই জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়ে দলীয়ভাবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের একটি রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। এর পর বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও বসতে চায় দলটি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাহী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে আমরা স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করব। এর পর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব। বিষয়টি গণমাধ্যমকেও জানানো হবে।

গত বৃহস্পতিবার সাংগঠনিক বিভাগ রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের নির্বাহী কমিটির সদস্য, জেলা ও মহানগরের সভাপতিদের মতামতের মধ্য দিয়ে সিরিজ বৈঠক শেষ হয়। এর আগে

দ্বিতীয় দফায় প্রথম দিন ২১ সেপ্টেম্বর সাংগঠনিক বিভাগ ঢাকা ও ফরিদপুর, দ্বিতীয় দিন ২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লার জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা সভাপতিদের মতামত নেয় বিএনপি। এর আগে প্রথম দফায় ১৪-১৬ সেপ্টেম্বর টানা তিন দিন নির্বাহী কমিটির নেতাদের মতামত নেওয়া হয়। নির্বাহী কমিটির ৫০২ সদস্যের কমিটির ৩৭৬ জন অংশ নেন। এ ছাড়াও অংশ নেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ৪৭ জন এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ১২২ জন নেতা।

দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, এই নিয়ে নির্বাহী কমিটির বৈঠকেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। পাশাপাশি দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। দলে শৃঙ্খলা ও ঐক্য ফেরানো না গেলে আন্দোলনে সফলতা আসবে না বলেও নেতারা মতামত দেন। এ অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে না জানিয়ে যারা সিরিজ বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন, তাদের সবার কাছেই শোকজের চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে একটি তালিকা করা হয়েছে। এই তালিকায় থাকা নেতাদের কাছে গতকাল শুক্রবার থেকে শোকজের চিঠি পাঠানো শুরু হয়েছে বলে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সূত্রে জানা যায়, আজ শনিবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিরিজ বৈঠকে নেতাদের মতামত নিয়ে পর্যালোচনা করা হবে। চলতি মাসে অথবা আগামী মাসের শুরুতে বিএনপি দলগতভাবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরার পাশাপাশি একটি রূপরেখা দিতে চায়। এই রূপরেখায় পেশাজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাদেরও মতামত নেওয়া হবে। সবাইকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতেই এই মতামত নেওয়া হবে। তবে কোনো কোনো নেতা সংবাদ সম্মেলনের আগেই সবার সঙ্গে মতবিনিময় করার পক্ষে। এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা জানান, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভাঙ্গা-গড়ার দিকে না গিয়ে তারা যুগপৎ আন্দোলন করার চিন্তা করছেন। গত ছয় দিনের সিরিজ বৈঠকেও নেতারা এমন মতামত দিয়েছেন।

দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা যায়, চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে দলের পুনর্গঠন কাজ শেষ করে দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা যাচাই করতে নেতারা মতামত দিয়েছেন। চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পাশাপাশি দেশে আন্দোলনের নেতৃত্বে একজন নেতা ঠিক করার পক্ষে মত দিয়েছেন। যদিও এ নিয়ে তারেক রহমান ছাড়া অন্য কেউ সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা জানান, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর দলের সিদ্ধান্তহীনতায় নেতাকর্মীরা কোনো আশা না দেখে ‘চুপচাপ’ হয়ে যায়। সিরিজ বৈঠকের মধ্য দিয়ে নেতারা অনেকটা উজ্জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বিগত আন্দোলন-সংগ্রামের আগে কেন্দ্রীয় এবং তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে আন্দোলন বিষয়ে যে কঠোর মনোভাব দেখা যেত, এবারের সিরিজ বৈঠকে তা দেখা যায়নি। এ বিষয়টিও দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। আন্দোলনের চিন্তা মাথায় নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় কর্মপন্থা ঠিক করতে দলের নীতিনির্ধারকরা ১০ থেকে ১২ দফার একটি রূপরেখার খসড়া তৈরি করেন। এই খসড়া চূড়ান্ত করার আগে সবাইকে সম্পৃক্ত করতে জাতীয় নির্বাহী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মতামত নেওয়া হয়।

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, এই সরকারের অধীন ও বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে গেলে ফল ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতোই হবে। প্রায় সব নেতাই মত দিয়েছেন, এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যেতে হলে বিদ্যমান নির্বাচন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন আনতে হবে। আর তা করতে হলে আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এই আন্দোলনে সফল হতে নানা মতামতও দেন তারা। মোটা দাগে পাঁচটি বিষয়ে বেশি মতামত দিয়েছেন নেতারা। শীর্ষে ছিল নির্বাচন ইস্যু, আর তা হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে না যাওয়া। এর পরই ছিল দলকে ঐক্যবদ্ধ করার পরামর্শ। দল পুনর্গঠনে ক্ষোভ, কূটনৈতিক ব্যর্থতায় হতাশা প্রকাশ এবং জোট থেকে জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারে মতামত আসে।

বৈঠক সূত্র জানায়, সিরিজ বৈঠকের প্রথম দফার চেয়ে দ্বিতীয় দফায় জামায়াত ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ নেতা তাদের মতামত দিয়েছেন। সেখানে সবাই বিএনপিকে এককভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। দলের কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে বড় করে দেখা হচ্ছে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা জানান, তারা কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দলের নীতিনির্ধারকদের পিছিয়ে থাকার অভিযোগ তোলেন। বৈঠকে ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী ও বিগত সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়েও কথা বলেছেন নেতারা। ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিষয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন এবং আন্দোলন প্রশ্নে আমরা একটি রূপরেখা তৈরির কাজ করছি, মাঠের চাহিদা অনুযায়ী একটি সূচি তৈরির চেষ্টা করছি। এখন বৈঠক করে মতামত নেওয়া হচ্ছে, যাতে চূড়ান্ত রূপরেখায় তাদের মতের প্রতিফলন থাকে। যাতে কেউ এমনটি বলতে না পারেন যে, কেন্দ্র থেকে তাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিয়েছে।’

জানা গেছে, ধারাবাহিক এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত নীতিনির্ধারকরা লিপিবদ্ধ করেছেন। তা হচ্ছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে নেতৃত্ব ধার না করে বিএনপির নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তোলা, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে আনা, নব্বইয়ের চেতনা ভুলে যাওয়া, পরিকল্পনামাফিক আন্দোলনের ছক কষা, দীর্ঘসময় নয়- স্বল্পসময়ের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা, বিভেদ ভুলে দলে আত্মিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, কমিটি গঠনে অনৈতিক লেনদেন বন্ধ, আন্দোলনমুখী নেতৃত্ব বাছাই, সংগঠনকে শক্তিশালীকরণ, বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়, বিশ্ব পরিস্থিতি বুঝে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি এবং দলের অবস্থান পরিষ্কার করা। এর বাইরেও দলের স্থায়ী কমিটি এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির শূন্যপদ পূরণের পক্ষে মতামত দিয়েছেন নেতারা। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত পাওয়া গেছে। ধারাবাহিক বৈঠকে ঘুরেফিরে বেশিরভাগ নেতাই দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণকে ভুল ছিল বলে মতামত দিয়েছেন।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশের সবার একটা দাবি, তা হচ্ছে- নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই দাবির পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি বিএনপি করছে। জনগণ এই সরকারের অধীনে ভোট দিতে পারে না; তারা কীভাবে ভোট দিতে পারবে সেই পরিবেশ তো জনগণই ঠিক করবে। সেই কাজটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি করার উদ্যোগ নিয়েছে।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877